স্বৈরতন্ত্রের নতুন আখ্যান আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো

গত এক বছর ধরে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের আলোচিত নাম বেলারুশের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্রীয় বাহিনী নামিয়ে ভিন্নমত দমন ও প্রশ্নবিদ্ধ ভোটে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে তিনি ইউরোপে নব্য স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দিয়েছেন। আর এ কারণে পশ্চিমাদের কাছে লুকাশেঙ্কো করোনাভাইরাস থেকে কোনো অংশে কম আলোচিত বা তাৎপর্যপূর্ণ নন। 

গত সপ্তাহে বিমান ছিনতাই করে সাংবাদিক গ্রেফতার এবং এতে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যুদ্ধের সংগঠন হামাসের কথিত বোমা হামলার অজুহাত তুলে তিনি আবারও আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন।

জানমাল রক্ষার নামে ভিন্নমত দমন

গত ২৩ মে (রোববার) সমাজকর্মী ও সরকারবিরোধী সাংবাদিক রোমান প্রোতেসেভিচকে গ্রেফতার করতে গ্রিস থেকে লিথুয়ানিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দেওয়া রায়ান এয়ারের একটি বিমানের গতিপথ ঘুরিয়ে রাজধানী মিনস্কে নামতে বাধ্য করে বেলারুশ। আকাশ থেকে বিমান নামানোর কারণ হিসেবে ‘হামাসের বোমা হামলার হুমকি’ ছিল বলে দাবি করছে বেলারুশ কর্তৃপক্ষ। এই হুমকির উদ্ভব সুইজারল্যান্ডে হয়েছিল বলেও মন্তব্য করেন লুকাশেঙ্কো। তবে সুইস কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে হুমকির বিষয়ে কিছুই জানে না বলে জানিয়েছে। তারপরও বেলারুশ প্রেসিডেন্ট জোর দিয়ে বলেন, ‘বোমার হুমকিটি সত্যিই ছিল ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে হতে পারত।’

রায়ানএয়ার বলেছে, বিমানে তল্লাশি চালিয়ে কিছুই পাওয়া যায়নি। পাঁচ ঘণ্টা পর বিমানবন্দর ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে তার আগে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার অভিযোগ তুলে রোমান প্রোতেসেভিচ ও তার রুশ বান্ধবী সোফিয়া সাপিগাকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর থেকেই ইউরোপ ও আমেরিকাসহ আন্তর্জাতিক মহলের তীব্র নিন্দার মুখে পড়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। বেলারুশের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের’ অভিযোগ তুলে শাস্তি দাবি করেছে তারা। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব বেলারুশ সরকারকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘নজিরবিহীন’ এই পদক্ষেপের ‘গুরুতর পরিণতি’ হবে। 

ইউরোপের বেশিরভাগ এয়ারলাইন্স ইতিমধ্যে বেলারুশের আকাশসীমা বাদ রেখেই নিজেদের রুট পুর্ননির্ধারণ করে ফেলেছে। এছাড়া বেলারুশের রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইন্স বেলাভিয়ার অপারেটিং পারমিট বাতিল করেছে যুক্তরাজ্য। ইইউ নেতারা সদস্য দেশগুলোকে একই পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে।

ইউরোপ-আমেরিকায় যখন নিন্দার ঝড় বইছে, তখন বেলারুশের প্রেসিডেন্ট গত ২৬ মে (বুধবার) নিজের কৃতকর্মের সাফাই দিয়েছেন। দাবি করেন, তিনি বেলারুশের জনগণকে সুরক্ষিত রাখার জন্য আন্তর্জাতিক আইনের অধীনেই এ কাজ করেছেন। সংসদে দেওয়া ভাষণে লুকাশেঙ্কো বলেন, ‘যেমনটি আমরা আভাস দিয়েছিলাম, আমাদের যারা ক্ষতি চায়, দেশের বাইরে থেকে ও দেশের ভেতর থেকেও তারা আমাদের রাষ্ট্রের উপর আক্রমণের পদ্ধতি পাল্টেছে।’ 

তবে এক বিবৃতিতে রায়ানএয়ার বলেছে, বেলারুশ এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে বিমানটিতে বার্তা পাঠানো হয়, এটিতে ‘নিরাপত্তা হুমকিমূলক’ কিছু রয়েছে এবং তারা ফ্লাইটটি নিকটবর্তী মিনস্ক বিমানবন্দরে ঘুরিয়ে নিতে বলে। ফ্লাইটরাডার ২৪-এর ওয়েবসাইটে ফ্লাইটটির পথপরিক্রমা দেখে জানা যায়, যখন সেটি ঘোরানো হয়, তখন মিনস্কের চেয়ে ভিলনিয়াস ছিল কাছের বিমানবন্দর।

মিনস্ক বিমানবন্দরে আটকের পর গত ২৪ মে (সোমবার) প্রথমবারের মতো সাংবাদিকের একটি ভিডিও প্রকাশ করে বেলারুশ কর্তৃপক্ষ। এতে রোমান প্রোতেসেভিচ বলেছেন- তার স্বাস্থ্য ভালো রয়েছে। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আনা অভিযোগ স্বীকার করতেও দেখা গেছে। তবে দেশটির প্রধান বিরোধীদলীয় নেতাসহ অ্যাক্টিভিস্টরা ভিডিওটির সমালোচনা করে বলেছেন, চাপের মুখে রোমানকে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। 

লিথুয়ানিয়ায় নির্বাসিত বেলারুশের বিরোধী নেতা সভেৎলানা টিখানোভসকিয়া জানান, লুকাশেঙ্কো সরকার ২৬ বছর বয়সী রোমান প্রোতেসেভিচের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনার পর ২০১৯ সালে দেশ ছাড়েন তিনি। এরপর নেক্সটা মিডিয়ার মাধ্যমে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের খবর প্রকাশ করেন। ওই নির্বাচন ও তার পরবর্তী সময়ে বেলারুশের বিরোধীদের পক্ষে বড় ভূমিকা রেখেছিল নেক্সটা মিডিয়া। টেলিগ্রাম চ্যানেলের পাশাপাশি টুইটার ও ইউটিউবে তাদের খবর প্রকাশিত হয়। বেলারুশ কর্তৃপক্ষ প্রোতেসেভিচকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করায় দেশে তার মৃত্যুদ-ও হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন সভেৎলানা।

পোলিশ সম্প্রচারমাধ্যম টিভিএনে প্রোতেসেভিচের মা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে বলেছেন, ‘দয়া করে উঠে দাঁড়ান, সাহায্য করুন। আমি আপনাদের কাছে এই কাকুতি-মিনতি করছি- কারণ, তারা ওকে মেরে ফেলবে।’

বেলারুশের মিডিয়া সম্পর্কে দেশটির নাগরিক নিকিতা কাপ্লেংকো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘বেলারুশের পুরো মিডিয়া লুকাশেঙ্কোর পকেটে। তবুও টেলিগ্রাম নামের ফ্রি অ্যাপে ফ্রি চ্যানেল চালানো এক যুবক তার পুরো প্রোপাগান্ডা ইন্ডাস্ট্রির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি!’ কার্যত এর মধ্য দিয়েই বুঝা সম্ভব, কেন স্বৈরশাসকরা মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়; আর কেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাদের জন্য হুমকি।

ভোটে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র

১৯৯১ সালের ২৫ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে বেলারুশ পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে দেশটিতে অসন্তোষ প্রথম থেকেই তৈরি হয়। ১৯৯৪ সালে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সেখানে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সোভিয়েতকালে লুকাশেঙ্কো ছিলেন অন্যতম সফল সামরিক কর্মকর্তা। নির্বাচনে তিনি একচেটিয়া পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মাঝামাঝি একটি জনকল্যাণকর গণতন্ত্রের প্রচারণা সামনে আনেন। বেলারুশের জনগণের মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতি আস্থা ছিল না; আবার সমাজতন্ত্রের নামে সোভিয়েতকালের শেষের দিকে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়, সেটিও তাদের মনে গেঁথে ছিল। এ কারণে লুকাশেঙ্কোর প্রতি জনগণের আস্থা তৈরি হয়। বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ১৯৯৪ সালের ২০ জুলাই পূর্ব ইউরোপের দেশ বেলারুশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন লুকাশেঙ্কো।

গণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন হলেও তাকে বেলারুশ থেকে ‘গণতন্ত্রকে মুছে ফেলার কুশীলব’ বলে মনে করেন অনেকেই। অনেক স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের মতো লুকাশেঙ্কোর শাসন কাঠামোর মূল ভিত্তিও তথাকথিত উন্নয়ন। পূর্ব ইউরোপের অন্য দেশের তুলনায় বেলারুশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক গোছানো। অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে ২৭ বছরের শাসনে দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলকেও মূলধারায় এনে যুক্ত করেছেন লুকাশেঙ্কো। নাগরিক সুবিধার দিক থেকেও অগ্রগতি হয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। যা দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতিতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তবে দেশটির সাধারণ মানুষের আয় মাসে ৮০ থেকে ১৩৩ ইউরো। 

যদিও লুকাশেঙ্কোর দাবি, বেলারুশের সাধারণ মানুষের আয় ৪৫০ ইউরোর উপরে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত উন্নয়নের জাঁকজমকের মাঝে বেলারুশিয়ানরা হারিয়েছেন তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা- এমনকি ভোটের অধিকার। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে অন্য স্বৈরশাসকদের মতো তিনিও বেলারুশের সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছেন বলে অভিযোগ বিশ্লেষকদের। নির্বাচনী ব্যবস্থা, সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে গণমাধ্যম- রাষ্ট্রের যাবতীয় প্রতিষ্ঠান তার অধীন। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে তিনি নিজস্ব পাহারাদারে পরিণত করেছেন। দেশটিতে কে কি করবে, না করবে প্রায় সবকিছুই এখন লুকাশেঙ্কো নির্ধারণ করে দেন। সেই সঙ্গে রয়েছে ভয়াবহ দুর্নীতি।

বেলারুশের লিথুয়ানিয়াভিত্তিক সাংবাদিক তানিয়া হেনডেল বলেন, ‘ক্ষমতা গ্রহণের পর সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চরিত্রের লুকাশেঙ্কোকে আমরা দেখতে পাই। দেশের সংবিধানকে তিনি সম্পূর্ণ নিজের মর্জি মতো সাজিয়েছেন। যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেছিলাম, আমাদের সে স্বপ্নকে তিনি পুরোপুরি ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন। কার্যত তিনি আবারও বেলারুশকে রাশিয়ার স্যাটেলাইট রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। সর্বত্রই রাশিয়ার প্রভাব। আমাদের অর্জন কেবলমাত্র একটি পাসপোর্ট। আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র, তবে সেটি কেবল নামে। বাস্তবে আমরা রাশিয়ার একটি উপনিবেশ হিসেবে বসবাস করছি।’

তানিয়া আরও বলেন, ‘জাতিগতভাবে আমরা বেলারুশিয়ান। আমাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে; কিন্তু এখনো স্কুল-কলেজে আমাদের ভাষা সেভাবে শেখানো হয় না। স্বাধীনভাবে আমাদের ভাষা চর্চা করতে পারি না। আমাদের দেশে রুশ ভাষার প্রভাব অনেক বেশি। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে রাশিয়া অনেকটা ধ্বংস করে দিয়েছে। লুকাশেঙ্কো এতো কিছু দেখার পরও কিছু বলেন না। কেননা, রাশিয়ার সমর্থন ছাড়া তিনি কখনোই এ পর্যায়ে আসতে পারতেন না।’

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে নতুন করে যেভাবে রাশিয়া আবার আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে, সেটি সম্ভব হতো না যদি না ভ্লাদিমির পুতিন একজন লুকাশেঙ্কোকে কাছে না পেতেন। এ কারণে পুতিন প্রশাসনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় লুকাশেঙ্কোকে।

গতবছর আগস্টে এক বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বেলারুশে। বিরোধীরা দাবি করে আসছিলেন, ভোটে ‘পুকুরচুরি’ হয়েছে। এরপর থেকেই শুরু হয় আন্দোলন। লুকাশেঙ্কো রাষ্ট্রীয় বাহিনী নামিয়ে তীব্র দমন-পীড়ন চালান বিরোধীদের উপর। শত শত আন্দোলনকারীকে গ্রেফ্রতার করা হয়। কোথাও ন্যূনতম প্রতিবাদও সহ্য করা হচ্ছে না।

সব সমালোচনা উড়িয়ে দিয়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর ষষ্ঠবারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে নতুন মেয়াদে ক্ষমতাসীন হন লুকাশেঙ্কো। বিরোধী পক্ষ ওই শপথ অনুষ্ঠানকে ‘চোরদের বৈঠক’ হিসেবে অভিহিত করেছে। নির্বাসিত বিরোধী নেতা সভেৎলানা টিখানোভসকিয়া বলেন, ‘এটি একটি তথাকথিত শপথ অনুষ্ঠান। এটি প্রহসন মাত্র।’

ওয়াশিংটনভিত্তিক সাংবাদিক নাতালিয়া আন্তোনোভা ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘লুকাশেঙ্কোর কোনো সীমা নেই’ শীর্ষক এক কলামে লিখেছেন, যদি কেউ তার অপশাসনের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে, তাহলে তাকে নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হয়। নির্যাতন, গ্রেফতার, ধর্ষণ, খুন, গুম-এসবই লুকাশেঙ্কো সরকার আন্দোলনকারীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছে। আর লুকাশেঙ্কো এখন সব নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //